সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ১২:২৩ পূর্বাহ্ন
স্পোর্টস ডেস্ক, একুশের কণ্ঠ অনলাইন:: মুম্বাইয়ের ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে ব্যাটকে ‘তলোয়ার’ বানিয়ে লড়াইয়ের বিকল্প নেই। সাধারণত ওয়াংখেড়েতে বোলারদের করার তেমন কিছুই থাকে না। ওখানে যুদ্ধটা করতে হয় ব্যাটারদের! ওয়াংখেড়ের রণক্ষেত্রে এই লড়াইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা কুইন্টন ডি কক, হেনরিখ ক্লাসেন ও এইডেন মারক্রামের মতো যোদ্ধা পেলেও বাংলাদেশ পেয়েছে কেবল একজনকেই। ৩৮৩ রানের পাহাড়ে চড়তে লিটন-সাকিব-মুশফিকদের চওড়া ব্যাট ধারালো কোনও তলোয়ার হতে পারেনি। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করা মাহমুদউল্লাহ ছিলেন মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের রণক্ষেত্রে বাংলাদেশের একমাত্র যোদ্ধা।
মুম্বাইতে রান পাহাড় টপকে হয়তো দলকে জেতাতে পারেননি ‘আনসাং হিরো’ মাহমুদউল্লাহ। তারপরও ৫৮ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর যেভাবে নিজের ইনিংসটাকে গড়েছেন সেটি ছিল অবিশ্বাস্য। প্রোটিয়াদের আগুনে বোলিং একাই সামলাচ্ছিলেন একজন সত্যিকারের যোদ্ধার মতো। অথচ এই মাহমুদউল্লাহকে বিশ্বকাপ দলে রাখা, না রাখা নিয়ে নাটক কম হয়নি। বিসিবি কর্তা নাজমুল হাসান পাপন থেকে শুরু করে প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও মাহমুদউল্লাহ ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানান বক্তব্য দিয়েছেন। শেষ তিন সিরিজে দলে ছিলেন না মাহমুদউল্লাহ, ঠাঁই হয়নি এশিয়া কাপের দলেও। ক্রিকেটপাড়ায় তাই গুঞ্জন উঠেছিলো, এখানেই শেষ মাহমুদউল্লাহ অধ্যায়ের? তবে শেষমেশ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়ে ব্যাট হাতেই সমস্ত কিছুর জবাব দিয়ে যাচ্ছেন ডনাহাতি এই ব্যাটার।
মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক সেঞ্চুরি করে দলকে জেতাতে না পারলেও নিশ্চিতভাবেই মাহমুদউল্লাহ নিজে জিতেছেন! কাগিসো রাবাদার বলে অনসাইডে ঠেলে ২ রান নিয়ে মাহমুদউল্লাহ পৌঁছান ৯৯ রানে। পরের শর্ট বলে ফাইন লেগে খেলে সিঙ্গেলে নিতেই পৌঁছে যান নিজের চতুর্থ সেঞ্চুরিতে! এই সেঞ্চুরি যে দলকে জেতাচ্ছে না, সেটি খুব ভালো করেই জানতেন মাহমুদউল্লাহ। তবু উদযাপন করলেন নিজের মতো করে, আনন্দ নিয়ে। এরপর ড্রেসিংরুমের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন। প্রথমে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে, আকাশের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এর অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘ওপরে আল্লাহ আছেন।’
৪৬তম ওভারে কোয়েটজের বলে লম্বা শট খেলতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ধরা পড়ার আগে খেলে ফেলেন ১১১ রানের ঝকঝকে ইনিংস। ওয়াংখেড়েতে একমাত্র যোদ্ধা হয়ে ১১১ বলে ১১ চার ও ৪ ছক্কায় মাহমুদউল্লাহ তার ইনিংসটি সাজান। এখনও পর্যন্ত ব্যাটারদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার ভিড়ে মাহমুদউল্লাহ নিয়মিত আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন। এই বিশ্বকাপে টিম কম্বিনেশনের কারণে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহকে একাদশের বাইরে থাকতে হয়েছে। ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচে লড়াই করলেও ইনিংস বড় করার সুযোগ পাননি সেভাবে। ৩ ইনিংসে ব্যাট করে মাহমুদউল্লাহর রান সবচেয়ে বেশি, ১৯৮।
মাহমুদউল্লাহর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের যে তিনটি সেঞ্চুরি, তার শেষটি এসেছিল ২০১৭ সালের জুনে। কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলেছিলেন ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস। তার আগে ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টানা দুই সেঞ্চুরি করে ইতিহাস গড়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তার চার সেঞ্চুরির সবকটিই বিদেশের মাটিতে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান তিনি, এবার বিশ্বকাপে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিকও বনে গেলেন মাহমুদউল্লাহ। এদিন সেঞ্চুরির আগে নতুন এক মাইলফলকে পা রাখেন তিনি। তামিম ইকবালকে টপকে ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশিদের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তিনে উঠে এসেছেন তিনি। ২৯ ইনিংসের তামিমের রান ৭১৮। অন্যদিকে ২১ ইনিংসে মাহমুদউল্লার রান ৭৯১। এই তালিকায় ১ হাজার ২০২ রান নিয়ে সবার শীর্ষে আছেন সাকিব আল হাসান। ১ হাজার ৪২ রান নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে মুশফিক।
প্রায় ১৭ বছর ধরে ‘আনসাং হিরো’ হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে চলছেন ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। মহাগুরুত্বপূর্ণ সময়ে সত্যিকারের একজন লড়াকু সৈনিক হয়ে উঠছিলেন সাবেক টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। ভক্তরা তাইতো মাহমুদউল্লাহকে ‘সাইলেন্ট কিলার’ নাম দিয়েছেলেন। এই নামটা মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে খুব একটা বেমানান নয়। ক্যারিয়ারে অনেক বড় বড় জয়ে অবদান রাখলেও কখনোই আলোয় ছিলেন না তিনি। নীরবেই সবার অলক্ষে নিজের কাজটুকু ঠিকঠাক করে গেছেন। দলের বিপদে ইনিংস মেরামত করায় মাহমুদউল্লাহর জুড়ি ছিল না। তার ভক্তরা তাইতো তাকে ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে ডাকতেন।
৩৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার এখন শেষলগ্নে। বিশ্বকাপের পর আরও কিছুদিন খেললেও নিশ্চিত ভাবেই মাহমুদউল্লাহর এটাই শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। দল ভালো না করলেও মাহমুদউল্লাহ তিন ইনিংসেই দারুণ ব্যাটিং করেছেন। নিজের শেষ বিশ্বকাপটি রঙিন ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারলে জবাব দেওয়া হবে অনেক কিছুরই। মাহমুদউল্লাহ হয়তো মুচকি হেসে ব্যাট নামক তলোয়ার হাতে সেই কাজটিই করছেন!